এক্সক্লুসিভ

প্রতিদিনই বাড়ছে রোগী, মশারি থাকলেও ব্যবহার করেন না রোগী!

নিউজ ডেস্ক

শেয়ারঃ

main

সংগৃহীত

প্রতি বছরই রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনের বাসিন্দাদের নাজেহাল করে তোলে ডেঙ্গুর বাহক ক্ষুদ্র মশা। অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে সরকারি হাসপাতালগুলোর ডেঙ্গু ওয়ার্ডে রোগীর চাপ সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। গত কয়েক বছরে ডেঙ্গুতে অসংখ্য প্রাণহানি ঘটলেও এর লাগাম টেনে ধরতে পারেনি ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন।


হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের বেডে মশারি টাঙানোর নিয়ম থাকলেও কোনো বেডেই তা দেখা যায়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নার্স বলেন, রোগীদের জন্য মশারি থাকলেও গরমের কারণে অনেকে তা ব্যবহার করতে চান না। আমাদের পক্ষ থেকে টাঙিয়ে দেওয়া হলেও তারা খুলে ফেলেন

রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সরেজমিনে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল পরিদর্শনে দেখা যায়, গত ২২ সেপ্টেম্বর বিকেল পর্যন্ত সাতজন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন। আগে থেকে ভর্তি ছিলেন ১৩ জন। হাসপাতালটির মেডিসিন ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন


হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের বেডে মশারি টাঙানোর নিয়ম থাকলেও কোনো বেডেই তা দেখা যায়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নার্স বলেন, রোগীদের জন্য মশারি থাকলেও গরমের কারণে অনেকে তা ব্যবহার করতে চান না। আমাদের পক্ষ থেকে টাঙিয়ে দেওয়া হলেও তারা খুলে ফেলেন।

ডেঙ্গুর ভরা মৌসুমে বেশির ভাগ হাসপাতালে দেখেছি রোগীদের মশারির মধ্যে থাকতে দেওয়া হয়। এই হাসপাতালে রোগীদের মশারির মধ্যে রাখা হয়নি। মূলত গরমের জন্যই রোগীরা মশারি টাঙিয়ে রাখেন না। তবে, আমার মনে হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে আরও কঠোর হওয়া উচিত খিলক্ষেতের বাসিন্দা সজিবুর রহমান

তিনি বলেন, হাসপাতালে প্রতিদিন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছেন। মাঝে মাঝে হঠাৎ ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। আবার রোগীর ফ্লো কমেও যায়। রোগী ভর্তি হলে সাধারণত তিন থেকে চার দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়। এরপর বাড়িতে গিয়ে রেস্ট নিতে বলা হয়। বর্তমানে রোগীর যে ফ্লো তাতে ধারণা করা যাচ্ছে সামনে রোগীর সংখ্যা বাড়তে পারে।


খিলক্ষেতের বাসিন্দা সজিবুর রহমান চার দিন ধরে কুর্মিটোলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বলেন, ‘ডেঙ্গুর ভরা মৌসুমে বেশির ভাগ হাসপাতালে দেখেছি রোগীদের মশারির মধ্যে থাকতে দেওয়া হয়। এই হাসপাতালে রোগীদের মশারির মধ্যে রাখা হয়নি। মূলত গরমের জন্যই রোগীরা মশারি টাঙিয়ে রাখেন না। তবে, আমার মনে হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে আরও কঠোর হওয়া উচিত।’

মশারি টাঙানোর জন্য আমাদের সরাসরি নির্দেশনা দেওয়া আছে। যদি কোথাও মশারি টাঙানো না থাকে তাহলে নিশ্চয়ই রোগী নিজেই মশারি টাঙাতে দেয়নি বা খুলে ফেলেছে। তবুও আমরা খোঁজ নিয়ে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করব ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান, পরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

‘এখানে ডেঙ্গু রোগীর জন্য আলাদা কোনো ওয়ার্ড নেই, মেডিসিন ওয়ার্ডেই সব ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা চলছে। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে দুই থেকে তিন দিন পর চলে যাচ্ছেন।’

মশারি টাঙানো হচ্ছে না— এমন অভিযোগের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক বিভাগের পরিচালক ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মশারি টাঙানোর জন্য আমাদের সরাসরি নির্দেশনা দেওয়া আছে। যদি কোথাও মশারি টাঙানো না থাকে তাহলে নিশ্চয়ই রোগী নিজেই মশারি টাঙাতে দেয়নি বা খুলে ফেলেছে। তবুও আমরা খোঁজ নিয়ে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।


গত ২২ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, চলতি বছর ডেঙ্গুতে ১৭৯ জন মারা গেছেন। তাদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মারা গেছেন। মৃত্যুর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অনেকেই দেরিতে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে এসেছেন, ফলে চিকিৎসার সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে।

গত বছরের পরিসংখ্যান তুলে ধরে মহাপরিচালক বলেন, ২০২৪ সালের জুনে মারা যান আটজন, জুলাইয়ে ১৪ জন, আগস্টে ৩০ জন এবং সেপ্টেম্বরে ৮৭ জন। ওই বছর জুনে রোগী ভর্তি হয়েছিল ৭৯৮ জন, জুলাইয়ে ২৬৬৯, আগস্টে ৬৫২১ এবং সেপ্টেম্বরে ১৮৯৭ জন। পরিসংখ্যান স্পষ্ট করছে, সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুর প্রকোপ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায় এবং মৃত্যুও ঘটে সবচেয়ে বেশি।


রাজধানীর ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ১৩টি ওয়ার্ডে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের (২০-এর বেশি) তুলনায় বেশি। এই এলাকাগুলোকে ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলো হলো— ২, ৮, ১২, ১৩, ২২ ও ৩৪। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ঝুঁকিতে থাকা ওয়ার্ডগুলো হলো— ৩, ৪, ২৩, ৩১, ৪১, ৪৬ ও ৪৭।

সিটি কর্পোরেশনের ব্যর্থতা

গত বছরগুলোতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগ নিলেও ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন আশানুরূপ ফল পায়নি। ডিএনসিসি মশার উৎপত্তিস্থল শনাক্ত করতে ড্রোন ব্যবহার এবং পরিত্যক্ত জিনিসপত্র কিনে নেওয়ার উদ্যোগ নিলেও তা সফল হয়নি। অন্যদিকে, ডিএসসিসি খাল ও জলাশয়ে ব্যাঙ, গাপ্পি মাছ এবং হাঁস ছেড়ে মশার লার্ভা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু এই অভিনব উদ্যোগগুলোও মশার উপদ্রব থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে পারেনি।


বিশেষজ্ঞের মতামত

কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগীর উপস্থিতি ও মশার ঘনত্বের মধ্যে একটি সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। রোগী-মশার সংযোগটি ভেঙে দিতে পারলেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।’

এ বিষয়ে তিনি তিনটি প্রধান পদক্ষেপ গ্রহণের কথা উল্লেখ করেন। প্রথমত, রোগীকে মশারির মধ্যে রাখা। এটি ভাইরাস, মশা এবং মানুষের মধ্যে সংক্রমণ চক্রকে ভেঙে ফেলতে সাহায্য করে। দ্বিতীয়ত, ফগিং ও স্প্রে। ডেঙ্গু রোগীকে কেন্দ্র করে ২০০ মিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে ফগিং ও স্প্রে করে মশা নিধন করতে হবে। কারণ, এডিস মশা সাধারণত এর বাইরে যায় না। তৃতীয়ত, ব্রিডিং সোর্স ম্যানেজমেন্ট। অর্থাৎ যেসব পাত্রে পানি জমে থাকে (যেমন- ফুলের টব, টায়ার, প্লাস্টিকের পাত্র) সেগুলো নিয়মিত পরিষ্কার বা সরিয়ে ফেলতে হবে।


সম্পর্কিত খবর