এক্সক্লুসিভ

বরিশালে ডেঙ্গুর দ্বিতীয় ঢেউ, বাড়ছে উদ্বেগ

নিউজ ডেস্ক

শেয়ারঃ

main

সংগৃহীত

বরিশালে দ্বিতীয়বারের মতো ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে, যা স্বাস্থ্য বিভাগকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। জেলার বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে জানা গেছে, প্রায় প্রতিটি পরিবারেই একাধিক সদস্য ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।


পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার মোসলেম উদ্দিন তার ছেলেকে নিয়ে এসেছেন বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তিন দিন চিকিৎসা নিলেও রোগীর অবস্থার উন্নতি হয়নি। মোসলেম উদ্দিন বলেন, ‘উপজেলা হাসপাতালে শুধু গ্যাসের ট্যাবলেট আর নাপা দিত। তিন দিনে রোগীর প্লাটিলেট এক লাখ থেকে কমে ৫৫ হাজারে নেমে এসেছে।’

‘দুই মাস আগে আমারেও ডেঙ্গুতে ধরছিল। এক্কেবারে মউতের ঘর দেখাই ছাড়ছে। এখন ধরছে পোলারে। জানি না ভাগ্যে কী আছে?’


একই অভিজ্ঞতা বরগুনার গৌরীচন্না ইউনিয়নের রমা রাণীর। তার মেজো ছেলে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার চার দিন পর মোটামুটি সুস্থ হয়েছেন। এর আগে তার বড় ছেলেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। বরিশালের উজিরপুরের বাসিন্দা মর্জিনা বেগম তার ষাটোর্ধ্ব স্বামীকে নিয়ে এসেছেন। গৃহস্থালির কাজ করতে গিয়ে তিনি আক্রান্ত হয়েছেন বলে তার ধারণা।

বিজ্ঞাপন

মর্জিনা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী গৃহস্থের কাজ করেন। সারাদিন গরু-বাছুর দেখভাল করেন। আমি মনে করি আথালে গেলে মশায় কামড়েছে। তার বয়স ষাটের ওপরে। এজন্য বেশ অসুস্থ। কয়েক মাস আগে আমার ছোট ছেলেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল।’

বরিশাল বিভাগে ১ জানুয়ারি থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১২ হাজার ৭৬০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ২৯ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত বরগুনায় ৬৯৯১ ও সর্বনিম্ন ঝালকাঠিতে ৩০৭ জন। মৃত্যুর দিক দিয়েও বরগুনায় বেশি ১১ জন। শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৭ জন মারা গেলেও তারা বিভিন্ন জেলার

হাসপাতালের রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় প্রতিটি পরিবারের একাধিক সদস্য ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও।


সাধারণত বর্ষা মৌসুম ডেঙ্গুর ডিক টাইম। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে পিক টাইম আমরা ধরেই নিয়েছি। কিন্তু বরিশাল বিভাগে ভিন্ন ঘটনা ঘটেছে। জুন-জুলাইতেও পিক টাইম ছিল। অর্থাৎ বরিশাল বিভাগ দুই দফায় ডেঙ্গুর পিক টাইম মোকাবিলা করছে ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মন্ডল, পরিচালক, বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

স্বাস্থ্য বিভাগের বিশ্লেষণ

বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মন্ডল বলেন, সাধারণত বর্ষা মৌসুম ডেঙ্গুর ডিক টাইম। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে পিক টাইম আমরা ধরেই নিয়েছি। কিন্তু বরিশাল বিভাগে ভিন্ন ঘটনা ঘটেছে। জুন-জুলাইতেও পিক টাইম ছিল। অর্থাৎ বরিশাল বিভাগ দুই দফায় ডেঙ্গুর পিক টাইম মোকাবিলা করছে।


‘ভারী বৃষ্টি না হওয়ায় ডেঙ্গুর সংক্রমণ দ্বিতীয় দফায় বেড়েছে বলে মনে করি। ভারী বৃষ্টি হলে এডিসের লার্ভা ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এ বছর বৃষ্টি যা হয়েছে তা ইলশেগুঁড়ির চেয়ে সামান্য বেশি। এতে পাতা, পাত্র, ডোবা, নালা, গর্তে পানি জমে ছিল। সেসব স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশা বংশ বিস্তার করেছে।’

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। ওষুধ সরবরাহ নেই। অনেক হাসপাতাল তিন/চারজন ডাক্তার দিয়ে চলে। এজন্য সেখানে ডেঙ্গুর মতো গুরুত্বপূর্ণ রোগীর ট্রিটমেন্ট না করাই নিরাপদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক)

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বরিশাল বিভাগে ১ জানুয়ারি থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১২ হাজার ৭৬০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ২৯ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত বরগুনায় ৬৯৯১ ও সর্বনিম্ন ঝালকাঠিতে ৩০৭ জন। মৃত্যুর দিক দিয়েও বরগুনায় বেশি ১১ জন। শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৭ জন মারা গেলেও তারা বিভিন্ন জেলার।


সুচিকিৎসা মেলে না উপজেলা হাসপাতালে

ঝালকাঠি জেলার কাঠালিয়া উপজেলার বাসিন্দা শাহীন মিয়া ছেলেকে নিয়ে এসেছেন শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ডেঙ্গুর সন্দেহ নিয়ে গিয়েছিলেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে রোগীর উপসর্গ দেখে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বরিশালে।


তিনি বলেন, ‘কাঠালিয়ায় ট্রিটমেন্ট নাই। সেখানে স্যালাইনও আমাদের টাকা দিয়ে কিনতে হয়। গেলেই বলে, জ্বর বেশি হলে বরিশালে নিয়ে যান। বরিশালে যে নিয়ে আসছি তাতেও কর্জ করা লাগছে।’

বিশেষজ্ঞ দলটি দৈবচয়ন ভিত্তিতে পৌরসভা এলাকায় মোট ১৩৮টি বাড়ির বিভিন্ন অংশে জমে থাকা পানির স্যাম্পল সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে ৪৩টি বাড়ির পানিতে এডিস মশার লার্ভা পেয়েছে। অর্থাৎ বরগুনা পৌরসভার ৫৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ বাড়ির পানি ডেঙ্গু সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া থেকে আসা খোকন হাওলাদার বলেন, ‘আমার বাবাকে নিয়ে এসেছি। উপজেলা হাসপাতালে যাওয়ার পর এক রাত বেডে শোয়ায়ে রেখেছে। না একবার ডাক্তার এসেছে, না জ্বর মেপেছে। শেষে বরিশালে নিয়ে এসে জেনেছি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত।’

‘বরিশাল মেডিকেল ছাড়া বিভাগের কোনো উপজেলা হাসপাতালে ট্রিটমেন্ট পাবেন বলে মনে হয় না।’


বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য না দিলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। ওষুধ সরবরাহ নেই। অনেক হাসপাতাল তিন/চারজন ডাক্তার দিয়ে চলে। এজন্য সেখানে ডেঙ্গুর মতো গুরুত্বপূর্ণ রোগীর ট্রিটমেন্ট না করাই নিরাপদ।

ডেঙ্গু বাড়ার কারণ

নদীবিধৌত এ অঞ্চলে দ্বিতীয় দফা ডেঙ্গুর ঢেউ নিয়ে উদ্বিগ্ন সবাই। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২৯ জন। উপকূলীয় জেলা বরগুনাকে ‘ডেঙ্গুর হটস্পট’ ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

একই অভিজ্ঞতা বরগুনার গৌরীচন্না ইউনিয়নের রমা রাণীর। তার মেজো ছেলে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার চার দিন পর মোটামুটি সুস্থ হয়েছেন। এর আগে তার বড় ছেলেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। বরিশালের উজিরপুরের বাসিন্দা মর্জিনা বেগম তার ষাটোর্ধ্ব স্বামীকে নিয়ে এসেছেন। গৃহস্থালির কাজ করতে গিয়ে তিনি আক্রান্ত হয়েছেন বলে তার ধারণা

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) বলছে, ডেঙ্গু বিস্তারের কারণ শনাক্তে বিভিন্ন পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ টিম কাজ করছে। ১৭-১৯ জুন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগী এবং অধিক সংক্রমিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন প্রতিষ্ঠানটির ছয় রোগতত্ত্ববিদ। সংক্রমণ ও ডেঙ্গুর ধরনের ওপর নির্ভর করে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে পৃথক পৃথক তথ্য উঠে এসেছে।


বিশেষজ্ঞ দলটি দৈবচয়ন ভিত্তিতে পৌরসভা এলাকায় মোট ১৩৮টি বাড়ির বিভিন্ন অংশে জমে থাকা পানির স্যাম্পল সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে ৪৩টি বাড়ির পানিতে এডিস মশার লার্ভা পেয়েছে। অর্থাৎ বরগুনা পৌরসভার ৫৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ বাড়ির পানি ডেঙ্গু সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।

বিপরীতে ইউনিয়ন পর্যায়ের ৪৬টি বাড়ির জমে থাকা পানির স্যাম্পল সংগ্রহ করে ৩৫টি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভার পাওয়া গেছে।

মশক নিধনের কার্যক্রম নেই

ডেঙ্গু নিরোধে মশক নিধন অভিযান জোরদারের কথা বলা হলেও এটি প্রয়োগের তথ্য তেমন পাওয়া যায়নি। বিষয়টি নিয়ে ভান্ডারিয়া, পিরোজপুর, কাউখালী, দুমকি, পটুয়াখালী ও বেতাগী পৌরসভার দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছে ঢাকা পোস্ট। তারা দাবি করেছেন, নিয়মিত মশক নিধনে স্প্রে ও ফগ মেশিন ব্যবহার করা হচ্ছে।

তবে, ভান্ডারিয়া সদরের বাসিন্দা দিপক শীল বলছেন, গত তিন/চার বছরে আমি দেখিনি মশা নিধনে কোনো কাজ হয়েছে। আগে ড্রেন পরিষ্কার করা হতো। ৫ আগস্ট এমপি-মন্ত্রী, মেয়র পালিয়ে যাওয়ার পর আর কিছুই হচ্ছে না।

কথা হয় বেতাগী উপজেলা সদরের বাসিন্দা ইসমাইল হোসেনর সঙ্গে। তিনি বলেন, শহরে কোনো পরিচ্ছন্ন অভিযান চালায় না কেউ। মশার ওষুধ তো দূরের কথা, ড্রেন পরিষ্কারও করে না পৌরসভা।

পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে কথা হয় বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মশক নিধন কর্মকর্তা স্বপন কুমার দাসের সঙ্গে। তিনি বলেন, এডিসের লার্ভা ধ্বংস করতে কার্যকর ওষুধ সরবরাহ করা দরকার। বাস্তবতা হলো অনেক স্থানেই এমন ওষুধ নেই। আমাদেরও ছিল না। প্রশাসক স্যার উচ্চ ক্ষমতার কার্যকর ওষুধ নতুন করে সরবরাহ করিয়েছেন। যে কারণে জনবহুল বরিশাল নগরীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ নেই বললেই চলে। এখন পর্যন্ত মহানগরী এলাকার এক বাসিন্দা মারা গেছেন। তিনিও ঢাকাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন।


সম্পর্কিত খবর